আজ আমি কোনো টিপস নিয়ে হাজির হয়নি। আজ হাজির হয়েছি প্রযুক্তির জগতে কিভাবে বাংলা সফটওয়্যারের আবির্ভাব হল সে বিষয় আলোচনা করতে। বাংলা সফটওয়্যার বাংলাদেশে কম্পিউটার ব্যবহারের সূচনা হয় আশির দশকের গোঁড়ার দিকে। এই প্রযুক্তিতে বাংলা ব্যবহারের চেষ্টা শুরু হয় তার কয়েক বছর পর। কম্পিউটারে বাংলা লেখার জন্যে দুটি উপাদান দরকার। তার একটি হলো বাংলা ফন্ট, আর অপরটি হলো একটি কিবোর্ড ড্রাইভার বা একটি ওয়ার্ড প্রসেসিং সফটওয়্যার। উপাদান দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হলেও একটির ব্যবহার অন্যটির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। এই উপাদান দুটিকে একত্রে বাংলা সফটওয়্যার হিসেবে বর্ণনা করা হলো।
বাংলাদেশে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হবার পর দুই দশক অতিক্রান্ত হলেও এখনো বাংলা সফটওয়্যারের ব্যাপারে উল্লেখ করার মতো সরকার কর্তৃক গৃহীত কোনো ফলপ্রসূ উদ্যোগ দেখা যায় না। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নির্মাতার অপরিকল্পিতভাবে তৈরি অসংখ্য বাংলা সফটওয়্যারের ভিড়ে কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহারকারী বা ব্যবহারেচ্ছুদের দিশেহারা অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে।
বাংলা সফটওয়্যার তৈরির উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টা মূলত ব্যক্তিগত বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। এঁদের অনেকেই প্রবাসী বাংলাদেশী। বাংলা সফটওয়্যার তৈরির প্রথম ধাপ অনিবার্যভাবে ছিল বাংলা ফন্ট তৈরি করা। বাংলাদেশের কে প্রথম বাংলা ফন্ট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন সে সম্পর্কে দ্বিমত রয়েছে। নিম্নে প্রদত্ত তালিকায় অদ্যাবধি তৈরি বাংলা সফটওয়্যারসমূহ দেখানো হয়েছে। শুধুমাত্র বাংলাদেশী বা বাংলাদেশের সাথে সক্রিয় যোগাযোগ রেখে তৈরি সফটওয়্যারগুলি বাংলা সফটওয়্যার সারণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের ড. সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে সর্বপ্রথম (১৯৮২-১৯৮৬) কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহারের ওপর গবেষণা করা হয়। বাস্তবে এই কাজ থেকে কোনো ব্যবহারিক সুফল পাওয়া গেছে বলে জানা যায়নি। তখন প্রচলিত কম্পিউটারগুলি ছিল ডস ভিত্তিক (MS-DOS) এবং ম্যাকিন্টশ। ম্যাকিন্টশের গ্রাফিক্যাল ইন্টারফেসের ব্যবহারিক সুবিধার কারণে এবং পাবলিশিং শিল্পের প্রয়োজনে প্রথম দিকে ম্যাকভিত্তিক সফটওয়্যারের ব্যবহার ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ম্যাকের জন্য যে বাংলা সফটওয়্যারটি তৈরি হয় তা ‘শহীদলিপি’ নামে পরিচিত। সাইফ উদ দোহা শহিদ এটি তৈরি করেন। ফন্ট ও কিবোর্ড ড্রাইভার নিয়ে তৈরি এই প্যাকেজটি ১৯৮৪ সালে বাজারজাত হয়। ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ম্যাকিন্টশের জন্যে তৈরি ফন্ট ও কিবোর্ড প্যাকেজ ‘বিজয়’ প্রকাশ করে ঢাকার আনন্দ কম্পিউটার্স। জানা যায় এটির উদ্যোগী ছিলেন মোস্তফা জববার ও গোলাম ফারুখ আহমেদ। পরবর্তীতে এর উইন্ডোজ ভারশান তৈরি হয়।
কম্পিউটারে বাংলার ব্যবহার পাবলিশিং শিল্প-নির্ভর থাকায় ১৯৮৮ সালের আগ পর্যন্ত ডস প্ল্যাটফরমের জন্য কোনো বাংলা সফটওয়্যার তৈরিতে কেউ উদ্যোগী হননি। ১৯৯৮-র নভেম্বর মাসে অটোমেশন ইঞ্জিনিয়ার্সের এম শামসুল হক চৌধুরী ‘আবহ’ নামে ডসভিত্তিক একটি ফন্ট ও কিবোর্ডের প্যাকেজ বাজারজাত করেন। পরে আসে ‘অনির্বাণ’, পরবর্তীতে যার উইন্ডোজ ভারশান বেশ প্রচার লাভ করে। ডস মোডে গ্রাফিকাল ইন্টাফেস তৈরি করে সেইফ ওয়ার্কসের অংক ও সোহলের নির্মিত ‘বর্ণ’ অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৯৩-তে তাঁরা এটির উইন্ডোজ ইন্টারফেস নির্মাণ করেন এবং সর্বপ্রথম একটি বাংলা স্পেল চেকার সংযুক্ত করেন। উইন্ডোজ পিসির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং কম্পিউটার ব্যবহারের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নববই দশকে প্রচুর বাংলা সফটওয়্যার বাজারে আসে। ১৯৯৩-র জুন মাসে সরকারি অনুমোদনে তৈরি হয় ‘জাতীয়’। কিন্তু এটির ব্যবহার ছিল অত্যন্ত সীমিত। এসময়ে প্রশিকা কয়েকটি কিবোর্ড ড্রাইভার একত্রিত করে প্রকাশ করে ‘প্রশিকাশব্দ’। প্রশিকাশব্দের প্যাকেজে একটি বাংলা স্পেল চেকারও পরবর্তীতে যুক্ত করা হয়। ১৯৯৪ সালে আরো কয়েকটি বাংলা সফটওয়্যার প্রকাশিত হয় কিন্তু এর কোনোটিই তেমন উল্লেখযোগ্য বলে জানা যায় না।
প্রবাসী বাংলাদেশী কম্পিউটার বিজ্ঞানীগণও আশির দশকের শুরু থেকেই কম্পিউটারে বাংলাকে ব্যবহার করার জন্যে কাজ করতে থাকেন। ১৯৮৪ সালে থাইল্যান্ডের এ.আই.টি’তে ড. আবদুল মোত্তালেব ডস প্লাটফরমে একটি বাংলা ফন্ট নির্মাণ করেন। এ সস্পর্কে এর অধিক বিস্তারিত আর কিছু জানা যায়নি। ১৯৮৫ সালে আমেরিকাতে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ম্যাকিন্টশের জন্যে একটি বাংলা ফন্ট তৈরি করেন। তিনি ইংরেজি বর্ণমালার অনুকরণে বাংলা ব্যঞ্জণ বর্ণের যেগুলি যুক্তাক্ষর তৈরি করে সেগুলির একটি স্বাভাবিক মাপের আকৃতির পাশাপাশি একটি ছোট মাপের আকৃতি নির্মাণ করেন যুক্তাক্ষরের একটি অংশ হিসেবে ব্যবহারের জন্যে। কম্পিউটারের ৮ বিট কোডিং সিস্টেমে যেহেতু বাংলায় ব্যবহূত সবগুলি অক্ষর/চিহ্ন ঠাঁই দেয়া যায় না, তাই তিনি কম্পিউটারে বাংলা লেখার নিয়মে একটি পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। এতে অনেক সনাতন যুক্তাক্ষর নতুন আঙ্গিকে প্রতীয়মান হতো। বাংলার সনাতন লেখন পদ্ধতি পরিবর্তনে তাঁর প্রচেষ্টা নিয়ে তিনি আর এগিয়ে যাননি।
বাংলা সফটওয়্যারের জগতে একটি নতুন ধারা সূচীত হয় ১৯৯৮-র জুন মাসে আমেরিকা থেকে ‘অর্কসফট বর্ণ’ প্রকাশিত হবার পর। ড. আবদুস শাকিলের ডিজাইনকৃত কিবোর্ড লেআউট এবং এ্যালগরিদমে এটি তৈরি করেন তাহমিদ চৌধুরী। এটি ছিল একটি সীমিত সুযোগের ওয়ার্ড প্রসেসর। এর কিবোর্ডের বর্ণ বিন্যাসটি ছিল ধ্বনিভিত্তিক এবং একটি সহজ ও যৌক্তিক নিয়মের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। অর্কসফট বর্ণ পরবর্তীতে ‘লেখক’ নামে বাজারজাত হয় প্রতিভাসফটের মাধ্যমে। অর্কসফট বর্ণের পরে ১৯৯৯-২০০০ সালে আরো কয়েকটি বাংলা সফটওয়্যার ধ্বনিভিত্তিক বর্ণ-বিন্যাসের কিবোর্ড লেআউট নিয়ে তৈরি হয়। আদর্শ বাংলা, ন্যাচারাল বাংলা, বর্ণসফট বাংলা২০০০, বাংলা ওয়ার্ড এই ধরনের সফটওয়্যারের তালিকাভুক্ত। কিন্তু একমাত্র বাংলা২০০০ ছাড়া অন্য কোনোটিই একটি পূর্ণ যৌক্তিক নিয়ম তৈরি বা অনুসরণ করতে পারেনি। বর্ণসফট প্রকাশিত সীমিত সুযোগের ওয়ার্ড প্রসেসর বাংলা২০০০ সফটওয়্যারটি লিখেছেন আমেরিকা প্রবাসী ছাত্র আমিরুল ইসলাম মানিক।
লিনেক্স প্লাটফরমের জন্য এখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ বাংলা সফটওয়্যার না থাকলেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী এই মাধ্যমে বাংলা জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কানাডার নাগরিক আমেরিকায় কর্মরত তানিম আহমেদ এদের মধ্যে একজন অগ্রণী। বাংলার জন্য লিনেক্সের সিস্টেম লেভেল সাপোর্টের কাজ ছাড়াও ইউনিকোড ভিত্তিক ওপেন টাইপ ফন্ট তৈরির কাজে তিনি নিয়োজিত আছেন।
বাংলা সফটওয়্যার তৈরিতে বাংলাদেশীদের সঙ্গে কয়েকজন বিদেশীও সক্রিয়ভাবে এই প্রচেষ্টায় অংশ নিয়েছেন। এঁদের মধ্যে ইংল্যান্ডের এ্যালট্রুইস্টসের রবিন উপটন তৈরি করেন ‘একুশে’ নামে একটি add on বাংলা সফটওয়্যার কেবলমাত্র মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে লেখার জন্যে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং প্রবাসী ভারতীয় বাঙালিরাও প্রায় সমসংখ্যক বাংলা সফটওয়্যার তৈরি করেন।
বাংলা সফটওয়্যারের অভাবনীয় সংখ্যাধিক্যতা থেকে দুটি বিষয় পরিষ্কার: কম্পিউটারে বাংলা লেখা সহজ নয় এবং অনেক নির্মাতাই চেষ্টা করেছেন এই মাধ্যমে বাংলা লেখার কাজটিকে সহজ করতে। কিন্তু বলা যেতে পারে কেউই এতে সফল হননি। এ যাবত প্রকাশিত বাংলা সফটওয়্যারগুলি ব্যবহার করার প্রধান সমস্যা হলো সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে সাজানো একটি নতুন কিবোর্ড লেআউট অনুশীলন করে মুখস্থ করা। শুধুমাত্র পেশাজীবী বাংলা টাইপিস্ট ছাড়া আর কেউ ইংরেজি কিবোর্ডের পাশাপাশি বাংলা জন্যে আর একটি কিবোর্ড মুখস্থ করবেন না এটাই স্বাভাবিক। তাই দুই ডজনাধিক বাংলা সফটওয়্যার বাজারে থাকলেও বাংলাদেশী কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের শতকরা পাঁচ জনেরও কম কম্পিউটারে বাংলা লিখতে পারেন। কিবোর্ড ব্যবহার করে বাংলা লেখা রপ্ত কারা অত্যন্ত কঠিন ও সময়সাপেক্ষ বিধায় এক পর্যায়ে কম্পিউটারের মনিটরে বাংলা বর্ণমালায় মাউস ক্লিকের মাধ্যমে বাংলা লেখার জন্যেও সফটওয়্যার তৈরি করা হয়। এই প্রচেষ্টা কিবোর্ড ব্যবহার করে বাংলা লেখার অক্ষমতার স্বাভাবিক প্রতিফলন।
বাংলা বর্ণের সংখ্যাধিক্যতাকে বাংলা সফটওয়্যারের মূল অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। অথচ চীনা, জাপানী প্রভৃতি ভাষার সহস্রাধিক বর্ণ অতি সহজে ২৬টি ইংরেজি key ব্যবহারের জ্ঞান দিয়ে টাইপ করার ব্যবস্থা সেই সব দেশ করে নিয়েছে। বস্ত্ততঃ প্রায় সব ভাষাই তাদের বর্ণ ও উচ্চারণকে রোমান হরফে উপস্থাপন করার জন্যে একটি প্রমিত বর্ণান্তর পদ্ধতি (Standard Transliteration scheme) ব্যবহার করে। এই পদ্ধতি, যা এক ঘণ্টায় শিখে ফেলা যায়, ব্যবহার করে একজন বিদেশীও ভাষাটি পড়তে না পারলেও শুধুমাত্র শব্দের উচ্চারণ জেনে ওইসব ভাষা কম্পিউটারে লিখতে সক্ষম। কিন্তু বাংলাদেশে বাংলা সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি।
বর্ণসফটের প্রতিষ্ঠাতা আমেরিকা প্রবাসী ড. আবদুস শাকিল বাংলার জন্য সুদীর্ঘ গবেষণা শেষে এরূপ একটি যৌক্তিক ও পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি তৈরি করেন। এই পদ্ধতিতে সমোচ্চারিত কিন্তু ভিন্ন বানানের দুটি বাংলা শব্দকে রোমান হরফের মাধ্যমেও পৃথক করা যাবে। বর্ণসফট প্রকাশিত বাংলা২০০০ সফটওয়্যার সেই পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। শুধুমাত্র ২৬টি lower case key ব্যবহার করে ইংরেজি কিবোর্ডের সঙ্গে পরিচিত যে কেউ, এমনকি একজন বিদেশীও, মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে নিয়মটি রপ্ত করে অতি সাবলীলভাবে কম্পিউটারে বাংলা লিখতে পারবেন।
বাংলাদেশে কম্পিউটার ব্যবহারের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত একটির পর একটি বাংলা সফটওয়্যার প্রকাশিত হয়েছে। এর কোনোটিই ব্যবহারকারীদের সন্তুষ্টি লাভ করতে সক্ষম না হলেও বাংলাদেশে বর্তমানে সর্বাধিক ব্যবহূত বাংলা সফটওয়্যারের তালিকার শীর্ষে রয়েছে বিজয়। পেশাদার বাংলা টাইপিস্টগণের অধিকাংশই বিজয়ের ব্যবহারকারী। পরে সম্ভবত মুনীর অপটিমা টাইপ রাইটারের অনুকরণে তৈরি মুনীর কিবোর্ডের স্থান যা বেশ কয়েকটি প্যাকেজের সঙ্গে বাজারজাত করা হয়েছে। অন্যদিকে উত্তর আমেরিকাতে কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহারকারীগণ বেছে নিয়েছেন বর্ণসফট বাংলা২০০০। দেশের অপেশাদার বাংলা টাইপিস্টদের মধ্যেও বর্ণসফট বাংলা২০০০ জনপ্রিয়তা অর্জন করছে ধীরে ধীরে।
তথ্যসূত্র - বাংলাপিডিয়া।
Post a Comment